Tuesday, July 18, 2017

হিংস্র শ্বাপদে ক্ষতবিক্ষত এই কি আমার মাতৃভূমি ?

হিংস্র শ্বাপদে ক্ষতবিক্ষত এই কি আমার মাতৃভূমি ?

আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা । ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি প্রগতশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন । এরই ধারাবাহিকতায় দেশের চরম দুর্দিনে, মাতৃভূমির টানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক স্বপ্নবাজ যুবকদের সাথে তিনিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । স্বপ্ন দেখেন এ দেশটা হবে একটি ক্ষুধামুক্ত অসাম্প্রয়িক রাষ্ট্র, স্থান করে নিবে উন্নত দেশের পঙক্তিতে । থাকবে না কোন হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ । মানুষ মর্যাদা পাবে মানুষ হিসাবে । ৭১ এর টগবগে সেই তরুনের বয়স আজ ষাটের কোঠা থেকে সত্তুরের কোটায় এগিয়ে চলছে । বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে বিশ্বাসের ক্ষয়িষ্ণুতা । বিশ্বাসের চন্দ্রে আজ যেন গ্রহণ লেগেছে । দুষ্ট রাহুর করালগ্রাসের থেকে কোনমতে টিকে আছে সরু একফালি চাঁদ । তাও বুঝি নিভু নিভু করছে ! নিভে গেলেই সব শেষ; অন্ধকার ।


কিন্তু এমনতো হবার কথা ছিল না ? কেন এমন হল ? এরকম সহস্র কেনর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে বাবা-কাকাদের প্রজন্মের সাথে সাথে আমরা নতুন প্রজন্মও বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি । স্বাধীনতা শব্দকে আজ বড্ড পরিহাসের শব্দ বলে মনে হয় । একরাশ অবিশ্বস্ততার অন্ধকারে নিজেকে বড় অসহায় বলে বোধ হয় । যতদিন যাচ্ছে জীবনের মালা থেকে একটি একটি করে বছররূপী ফুল খসে খসে পড়ছে এবং তত বেশী করে মুখোমুখী হচ্ছি একঝাঁক রুঢ় বাস্তবতার । আশে পাশের চেনা মুখগুলোকে বড় অচেনা বলে মনে হয় ।

কোন সত্য বলার আগে দশবার দশদিকে তাকিয়ে নিতে হয় । সদা সর্বদাই আত্মবিশ্বাসের অভাব । এ অভাব টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলেছে সমস্ত সম্ভাবনা; সমস্ত সৃষ্টিশীলতা । লোভী, ভণ্ড, ছদ্মবেশী সাম্প্রদায়িক দানবেরা নৈরাজ্যের ঘুঙুর পায়ে দিয়ে সারাদেশময় এক আনন্দ উল্লাসে মত্ত । এদের অনুগামী নাগিনীরা সারাদেশময় বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে । বিষের চাদরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে দেশের আকাশ । শৃগালের দল, শকুনের দল, রক্ত মাংসের আকাঙ্ক্ষায় সদানুসরণ করছে তাদের ।

হায় দেশমাতৃকা ! হায় ১৯৭১ ! হায় কোথায় তোমার অসাম্প্রদায়িক চেতনা । তুমি কি ঘুমিয়ে আছো দেখতে পাচ্ছো না – তোমার পতাকা আজ খাঁমছে ধরেছে সেই পুরনো শকুন । তোমার সন্তানদের দিনে দিনে ভুল পথে প্ররোচিত করে জোটবদ্ধ হচ্ছে শকুনের দল । ছলে-বলে-কৌশলে শক্তিবৃদ্ধি ঘটছে তাদের, এদের আক্রমনে দিনে দিনে শূন্যের কোঠার দিকে ধেয়ে চলছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়; বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় । অসাম্প্রদায়িক বাংলা গড়ার ক্ষেত্রে, স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অগ্রগামী থেকে এই কি তাদের পুরষ্কার ! বীর তিলক পাবার বদলে তাদের কপালে জুটেছে পাঁঠার তিলক । দেশপ্রেমিক রাজাকারমুক্ত হিন্দু সম্প্রদায়কে বলির যুপকাষ্ঠে চড়িয়ে সেই বলির রক্ত-মাংস খাবার লোভে জোটবদ্ধ শকুনে সারা দেশ ছেয়ে যাচ্ছে । পরিনামে বছর বছর কমছে হিন্দু জনসংখ্যা । প্রতি বছর প্রায় লক্ষের অধিক করে কমতে কমতে ধেয়ে চলছে শূন্যের কোঠার দিকে ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুসারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের হিসাবে দেশে কমপক্ষে নয় লাখ হিন্দু কম আছে । এদের মধ্যে ১৫টি জেলায় গত দশ বছরে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে আশঙ্ক্ষাজনক হারে । এ জনসংখ্যা হচ্ছে –
বরিশাল বিভাগের বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা ;
খুলনা বিভাগের বাগেরহাট, খুলান, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া;
ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ;
রাজশাহী বিভাগের পাবান । (সূত্রঃ প্রথম আলো, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২)

সরকারী এ প্রতিষ্ঠানদ্বয়ের গবেষণালব্ধ তথ্যতে আমরা ক্রমবিলীয়মান হিন্দুদের চিত্র দেখতে পাই । কিন্তু বাস্তবের চিত্র এর থেকেও ভয়ংকর । এর উত্তরণে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করি হিংস্র শ্বাপদের এবং এই ধারাবাহিকতায় আমার সর্বপ্রকার বিভেদের দুয়ার চিরতরে বন্ধ করে গড়ে তুলি একটি অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা । যে স্বপ্ন আমরা স্বাধীনতার ঊষালগ্নে দেখেছিলাম । কিসের এতো সংখ্যা গুরু, সংখ্যালঘু । মুক্তিযুদ্ধের সময়তো বিভেদের কথা বলিনি । দীক্ষিত হয়েছিলাম স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ঐক্যের মূলমন্ত্রে ।

তাই আসুন মুক্তিযুদ্ধের সেই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উদাত্ত কন্ঠে বলি – “বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, আমরা সবাই বাঙালী ।”

লেখকঃ
শ্রী  কুশল বরন চক্রবর্তী 
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । 
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ,বাংলাদেশ ।