Tuesday, July 18, 2017

এসো ঋত-ঋদ্ধির পথে

এসো ঋত-ঋদ্ধির পথে

বর্তমানে আমাদের অনেকেরই ধারণা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পূর্ণটাই বুঝি বা ব্রিটিশদের অবদান । আমরা অশিক্ষিত চাষা-ভূষা ছিলাম । তারাই আমাদের কাছে প্রথম শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছেন । আবার অনেকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার করণে বলেন তুর্কিরাই প্রথম মাদ্রাসা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন করেন । তুর্কিরা মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদের শেকড় ছড়াতে শুরু করে একাদশ শতাব্দী থেকে । অনুরূপভাবে ব্রিটিশরাও তাদের সাম্রাজ্যবাদী শেকড় ছড়াতে থাকে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে । তাহলে আমাদের কি নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিলনা ? সবটাই কি আমরা পেয়েছি এই বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের থেকে !
এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আজ বড় প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে । এ ভূখণ্ডের আবহমান সংস্কৃতিকে যারা বুকে ধারণ করে আছে সেই হিন্দু জাতির আজ যাতনার অন্ত নেই । সীমাহীন মিথ্যাচারে আবহমান সংস্কৃতিকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেবার জন্য আছে একদল তথ্যসন্ত্রাসকারী । এদের প্রধান লক্ষ্য এ দেশের সংস্কৃতির অভিমুখকে ঘুরিয়ে দিয়ে অতীতের সাম্রাজ্যবাদীদের অপূর্ণ কর্মকে বর্তমানকালে পূর্ণ করে তোলা । সে লক্ষ্যেই চলছে তাদের ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সর্বপ্রকার কর্মকাণ্ড । এ কর্মকাণ্ডে তারা পুরোটাই প্রায় সফল । কারণ তাদের প্রচারণার ফলে হিন্দু জাতি আজ দিশেহারা । হিন্দু কিশোর, তরুণ, যুবক টেরও পাচ্ছেনা যে অজ্ঞাতসারে তারা কোন সর্বনাশা অন্ধকারময় তথ্যসন্ত্রাসের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে ।
এ জালে জড়িয়ে পড়ার দায় আমাদেরও কম নয় । ধর্মীয় কি শিক্ষা দিচ্ছি আমাদের ছেলে মেয়েদের ? এককথায় বলতে গেলে কিছুই না । আজ পড়াশুনার পাশাপাশি নাচ, গান, কবিতা, আবৃতি, খেলাধুলা সবকিছু শেখার সময় এবং টাকা পয়সা আমাদের আছে; শুধু একরাশ কার্পণ্য ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে । এর ফল তো আমরা চারপাশেই দেখতে পাচ্ছি । কোর্টে যখন ছেলে মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়, তখন মা বাবা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেললেও কোন লাভ তো হয়ইনা; উল্টো সেই ছেলে অথবা মেয়ের অচিন্ত্য, অস্রাব্য, অসভ্যতা পিতা মাতার সর্বসমক্ষে হজম করতে হয় । আর ধর্মীয় শিক্ষার নামে তাদের যা শিক্ষা দিচ্ছি তা হলো কতগুলো ঠাকুরমা দিদিমার গল্প । অবাস্তব, অলৌকিক পৌরাণিক উপাখ্যান এবং আশাস্ত্রীয় কিছু ব্যক্তিগত মতের কৃত্রিম কথার ফুলঝুড়ি ।
বেদ আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ । বেদের উপরেই সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত । সেই বেদের ছিটে-ফোঁটাও কি আছে আমাদের জনজীবনে ! বৈদিক সৃষ্টি তত্ত্ব যা কি-না পুরোটাই প্রায় বিজ্ঞানসম্মত অথচ আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দেই, মধু-কৈটভের মেদ থেকেই পৃথিবীর সৃষ্টি; এ কারণেই পৃথিবীর আরেক নাম মেদিনী । পুরাণের এ তথ্যের হয়তো কোন রূপক ব্যাখ্যা আছে । কারণ পুরাণগুলোর তৈরীই হয়েছে রূপকের মাধ্যমে, গল্পের মাধ্যমে বৈদিক জ্ঞানের প্রকাশ ঘটানোর জন্য । আমরা যদি সেই রূপকগুলো ধরতেই না পারি তবে তো সমস্যা হবেই । পুরাণগুলোর অনেক কথাই ব্যঞ্জনা এবং লক্ষণা অলঙ্কারের মাধ্যমে বলা । তাকে যদি আমরা অভিধা অর্থে গ্রহন করি তবে অর্থের বিকৃতি তো ঘটবেই । অর্থাৎ অলঙ্কারের মাধ্যমে সাহিত্যে যা বলা হয়েছে তার সবটাই আভিধানিক অর্থে গ্রহণ করা যাবে না । তাই পুরাণগুলোকে গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে ।
একটা টেবিলে কিছু ভালো ফল আছে এবং গুটিকয়েক পঁচা ফল আছে । একটা শিশু ফল খাবার জন্য দৌড়ে এসে যদি সেই গুটিকয়েক পঁচা ফলের উপরই তার হাত বাড়ায়, এবং মুখে দিয়ে বুঝতে পারে ফলটি পঁচা; তবে থু দিয়ে সে শুধুমাত্র পঁচা ফলটি ফেলে দিবে তাই নয়, তার ধারনা হবে টেবিলের সব ফলই বুঝি পঁচা এবং হাজার চেষ্টা করেও শিশুটিকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে যে টেবিলে ভাল ভাল সরস ফলও আছে । তার ধারণা জন্মাবে টেবিলের সব ফলই বুঝি পঁচা । এমনটাই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে প্রায় প্রত্যেকটা হিন্দু পরিবারে । শিশু বয়সে তাকে ঠাকুরমা দিদিমার গাল গল্পের মাধ্যমে যে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয় তার ভিৎ দিন দিন নরবরে হয়ে যায় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে । একুশ-বাইশ বছরের দিকে তার বুদ্ধি যখন পূর্ণতা পায় তখন সে ভাল মন্দ বিচার করতে পারে । তখন এ ভাল মন্দ বিচার করতে যেয়ে সে ধান এবং ধানের চিটাকে একাকার করে ফেলে এবং অজ্ঞানতার জন্য চিটার সাথে সাথে ধানকেও ঝেড়ে ফেলে দেয় । সঠিক-বেঠিক বোধটাকে সে গুলিয়ে ফেলে । পরিণামে সে হয়ে ওঠে অবিশ্বাসী । এ অবিশ্বাসের মাত্রা দিন দিন বাড়তে বাড়তেই সে হয়ে যায় ঘোরতর নাস্তিক । পরিণামে সে পরিবার, সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতির, মহাবৈরী হয়ে যায় । কিন্তু এর জন্য দায়ী কারা ? আমরাই । কারণ আমাদেরই দায়িত্ব ছিলো শিশুটিকে প্রকৃত বৈদিক শিক্ষা দেয়া এবং তা দিতে পারিনি বলেই আজ এ ঘটনা ঘটেই চলেছে । কিন্তু এ প্রপঞ্চকে আর কতদিন চলতে দেয়া যায় এবং অভিঘাতে আর কত পরিবার ধ্বংস হবে ?
এর উত্তর একটাই, তা হলো অনেক হয়েছে এবার মূলে ফিরুন । অর্থাৎ বেদ-বেদান্তের পথে আসুন । একটা সময় ছিল যখন আমরা পড়ালেখা জানতাম না এবং এ শাস্ত্র গ্রন্থগুলোও আমাদের হাতের কাছে ছিলো না । এগুলো ছিল হাতে লেখা পুঁথি । তখন খুব কম মানুষই পড়ালেখা জানত এবং সেই পড়ালেখা জানা মানুষের মধ্যে খুব কম লোকই সেই গ্রন্থগুলো পড়ার সুযোগ পেতো । কিন্তু আজ তো সেই সমস্যা নেই । আজ আমরা নতুন প্রজন্মের প্রায় অধিকাংশই পড়ালেখা জানি । এর সাথে আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থ হাতেলেখা পুঁথি থেকে আজ প্রেসে ছাপা পুস্তক আকারে আমাদের কাছে এসেছে । তাহলে কিসের এতো কার্পণ্য ?
সনাতন ধর্ম সভ্যতার সবকিছুই বেদের উপর প্রতিষ্ঠিত । তাই যতদিন আমরা বেদমাতা থেকে বিচ্যুত থাকব ততদিন আমাদের বর্তমান কালের মত হতভাগা হতচ্ছারার মত দিন কাটাতে হবে । কিন্তু যখন আমরা বেদ মাতার কোলে চড়ে তার অমৃতময় স্তন্য পান করব তখনই আমাদের জাতির জীবনে এক নতুন সূর্যোদয় হবে । যার প্রত্যাশাতেই আমাদের এ মূলে ফেরার আহ্বান, এসো ঋত-ঋদ্ধির পথে । অর্থাৎ সত্য সনাতন পরমেশ্বর এবং এর সাথে জাগতিক সমৃদ্ধিময় সুশৃঙ্খল বৈদিক জীবনের পথে এসো । এখানেই পরম আনন্দ ও শান্তি নিহিত ।
লেখকঃ
শ্রী  কুশল বরন চক্রবর্তী 
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । 
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ,বাংলাদেশ ।